আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন
- আপলোড সময় : ২৩-১০-২০২৫ ০৫:২১:৫১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৩-১০-২০২৫ ০৫:২২:১৫ অপরাহ্ন
* শিশু নির্যাতন রোধে আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল। * সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক চাপ এবং দুর্বল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক ঘটনা রিপোর্ট হয় না বা অমীমাংসিত থেকে যায়। * তদন্তে বিলম্ব এবং পারিবারিক প্রভাব ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে। * ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় পূর্ণাঙ্গ আইন না থাকায় অনেকেই অভিযোগ করতে ভয় পান। স্টাফ রিপোর্টার বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। শুধু মেয়ে শিশুরাই নয়, ছেলে শিশুরাও নির্যাতন-বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামপ্রতিক সময়ে এসব ঘটনা যে হারে বাড়ছে, তা সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩০৬ জন মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১৭৫। শুধু তাই নয়, এ সংখ্যা ইতোমধ্যেই গত পুরো বছরের রিপোর্ট হওয়া ২৩৪টি ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি। ভুক্তভোগীদের বয়সের পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছরের মধ্যে, ৯৪ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে এবং ১০৩ জন কিশোরী। ৬০টি ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স উল্লেখ করা হয়নি। মার্চ ও এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে- মার্চে ১০৬টি এবং এপ্রিলে ৬৪টি। অথচ গত বছর এই দুই মাসে যথাক্রমে ২৯ ও ২৪টি ঘটনা ঘটেছিল। সাত মাসে ২৫১টি ঘটনায় মামলা হয়েছে, ফলে ৫৫টি শিশু সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একই সময়ে ১২৯ জন মেয়েশিশু ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩৫ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছর, ৫৩ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর এবং ১২ জন কিশোরী। এর মধ্যে মাত্র ৮৫টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। ছেলেশিশুরাও এ ভয়াবহতার বাইরে নয়। সাত মাসে ৩০ জন ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একজনের বয়স ০ থেকে ৬ বছর, ১৭ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর এবং একজনের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। ১১টি ঘটনায় বয়স প্রকাশ করা হয়নি। এসব ঘটনার মাত্র ২০টিতে মামলা হয়েছে। একই সময়ে তিনজন ছেলে শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। সাত মাসে ছেলেশিশু ধর্ষণের সংখ্যা ২০২৪ সালে রিপোর্ট হওয়া মোট ৩৬টি ঘটনার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। শিশুরা অন্যান্য যৌন হয়রানিরও শিকার হয়েছে। ৪৯ জন মেয়েশিশু পথেঘাটে বখাটেদের দ্বারা উত্ত্যক্ত হয়েছে এবং ২২ জনকে শিক্ষকেরা যৌন হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রবণতা শুধু শিশুদের শারীরিক ক্ষতিই করছে না, বরং তাদের মানসিক বিকাশকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, শিশু নির্যাতন রোধে আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনি বিশেষজ্ঞ আয়েশা আক্তার বলেন, সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক চাপ এবং দুর্বল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক ঘটনা রিপোর্ট হয় না বা অমীমাংসিত থেকে যায়। তদন্তে বিলম্ব এবং পারিবারিক প্রভাব ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি উল্লেখ করেন, নতুন অধ্যাদেশে শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল এবং তদন্ত ও মামলা নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বাধ্যতামূলক করা হলেও আইনি অস্পষ্টতা, মামলার অমিল এবং বয়স-সম্পর্কিত জটিলতার কারণে যথাযথ পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় পূর্ণাঙ্গ আইন না থাকায় অনেকেই অভিযোগ করতে ভয় পান। পাশাপাশি তিনি ভুক্তভোগীদের উপর পুনরায় মানসিক আঘাত এড়াতে হাই কোর্টের ‘টু-ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধকরণ সঠিকভাবে কার্যকর করার আহ্বান জানান। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা ও জবাবদিহির অভাব অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দুর্বল থাকে এবং শাস্তির সম্ভাবনা কম থাকে, তখন অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। তিনি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চরমপন্থী প্রভাব এবং মানসিক বিকৃতিকে এসব অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মূল অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হলেও সহযোগীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। তিনি কার্যকর নজরদারি ও দ্রুত বিচারের ওপর জোর দেন এবং বলেন, আমরা ভিকটিমদের নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমাদের অপরাধীদের মনস্তত্ত্বও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলার কম রিপোর্টিং এবং নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙার প্রয়োজনীয়তার ওপরও তিনি জোর দেন। তার মতে, পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল-মাদ্রাসায় খোলামেলা আলোচনা জরুরি। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। মহল্লাভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি কার্যকর হতে পারে। পরিবারের ভূমিকা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবারের শক্তিশালী নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িতে শিশুদের ব্যক্তিগত সীমারেখা ও অন্যের প্রতি সম্মান শেখানো হলে তাদের ওপর নির্যাতনের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের আগে পরিবারের সঠিক দিকনির্দেশনাই হলো প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তিনি আরও বলেন, শিশু সুরক্ষায় স্কুলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই পাঠ্যক্রমে সেফটি এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। শিক্ষকদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা শিশুদের সুরক্ষায় সচেতন ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে এসব বার্তা পরিবার ও সমাজে আরও জোরালোভাবে পৌঁছে দিতে হবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ রোধে শুধু আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কার্যকর প্রয়োগ, দ্রুত বিচার, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা, পরিবার ও সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের বাড়তি প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার, সমাজ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার